মানবতার কল্যাণে অঙ্গিকারবদ্ধ

News

প্লাস্টিক দূষণ ও প্রতিকারের উপায়

পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তনশীল নগরায়ন ও শিল্পায়নের যুগে মানব সভ্যতার অগ্রগতির পাশাপাশি পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও দিন দিন বাড়ছে। এর অন্যতম বড় উদাহরণ হলো প্লাস্টিক দূষণ। এটি এমন একটি পরিবেশগত সংকট, যা এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীকুল এবং প্রকৃতির ভারসাম্যের ওপর গভীর হুমকি সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক, যাকে এক সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এখন তা অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এর কারণ হলো, এটি সাশ্রয়ী, টেকসই এবং বহুমুখী হলেও, এর অধিকাংশ ধরণই অপ্রাকৃতিক এবং সহজে অবিনষ্টযোগ্য নয়।

প্রতিদিন আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করি, তার বেশিরভাগ অংশ একবার ব্যবহারযোগ্য (single-use plastic)। খাবারের মোড়ক, চিপসের প্যাকেট, বোতল, চামচ-কাঁটা, পলিব্যাগ ইত্যাদি ব্যবহার শেষে সেগুলো আমরা বর্জন করি এবং অনেক সময় সেগুলোর যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। এই ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য নদী, খাল, নালা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছায়, যেখানে তা শত শত বছর ধরে জমে থেকে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আজকের দিনে সাগরের গভীরে থেকে শুরু করে বরফাচ্ছন্ন উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতেও প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সামুদ্রিক কচ্ছপের পেটের ভেতর প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, ডলফিনের গলায় পলিব্যাগ জড়িয়ে শ্বাসরোধে মৃত্যু ঘটেছে – এসব ঘটনা প্রতিনিয়তই সংবাদে উঠে আসছে।

 

তবে প্লাস্টিক দূষণ কেবল প্রাণীকুল বা সমুদ্রের জন্যই হুমকি নয়, এটি মানব স্বাস্থ্যকেও নীরবে বিপন্ন করছে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণাগুলো (মাইক্রোপ্লাস্টিক) আমাদের খাবার, পানির বোতল এমনকি বাতাসেও পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো শরীরের ভেতরে ঢুকে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও বন্ধ্যত্বের মতো গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে গবেষণায় জানা গেছে। এ ছাড়া প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে যে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, তা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠছে।

প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, চীন, বাংলাদেশসহ অনেক দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ বা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করেছে। তবে শুধু সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনধারায় পরিবর্তন আনাই হলো এই সমস্যার মূল সমাধান। সচেতনতা সৃষ্টি, বিকল্প পরিবেশবান্ধব সামগ্রীর ব্যবহার, রিসাইক্লিং ও পুনঃব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং ‘Reduce, Reuse, Recycle’ – এই তিনটি মূলনীতি অনুসরণ করেই আমরা প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করতে পারি।

এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব – প্লাস্টিক দূষণের উৎস কী, এটি কীভাবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং আমরা কীভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র হিসেবে এর বিরুদ্ধে সচেতন ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারি।

প্লাস্টিক দূষণ কী এবং এটি কেন একটি বৈশ্বিক সমস্যা:

প্লাস্টিক দূষণ বলতে বোঝানো হয় পরিবেশে অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য জমে থাকা, যা প্রকৃতি ও জীবজগতের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক মূলত এক ধরনের সিন্থেটিক (কৃত্রিম) পলিমার, যা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় সহজে পচে বা নষ্ট হয় না। এর অধিকাংশ ধরনের প্লাস্টিক শত শত বছর পর্যন্ত অবিনষ্ট থেকে যায়। আমরা যে প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, মোড়ক বা অন্যান্য সামগ্রী প্রতিদিন ব্যবহার করি, তা ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে থেকে যায় বছরের পর বছর।

প্রাথমিকভাবে প্লাস্টিক মানবজীবনকে সহজতর ও সুবিধাজনক করে তুলেছিল। কিন্তু এর অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও ব্যবহার বর্তমানে এক অভূতপূর্ব পরিবেশগত সমস্যার জন্ম দিয়েছে। আজকের দিনে প্লাস্টিক দূষণ কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের সীমাবদ্ধ সমস্যা নয়, এটি পরিণত হয়েছে একটি বৈশ্বিক সংকটে – যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে।

কেন এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা?

প্লাস্টিক দূষণ বৈশ্বিক সমস্যা হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিচে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-

১.বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ব্যবহার:
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০% প্লাস্টিকের দ্রব্য একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এই বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলকে প্রভাবিত করছে। উন্নত দেশ হোক বা উন্নয়নশীল—প্রত্যেক দেশই প্লাস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে দূষণের অংশীদার হয়ে উঠেছে।

২. প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব:
প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে নদী, হ্রদ, সাগর ও মহাসাগরে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এটি সামুদ্রিক পরিবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক খেয়ে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। আবার এই প্রাণী যখন মানব খাদ্যচক্রে আসে, তখন এর মাধ্যমে মানবদেহেও প্লাস্টিক কণিকা প্রবেশ করে।

৩.মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিশ্বব্যাপী উপস্থিতি:
প্লাস্টিক অল্প অল্প করে ক্ষয় হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয় এবং এটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র কণিকা যা চোখে দেখা যায় না। এই কণিকাগুলো এখন পানিতে, বাতাসে, এমনকি মানুষের রক্ত ও দুধেও পাওয়া যাচ্ছে। এটা প্রমাণ করে যে প্লাস্টিক দূষণ কেবল বাইরের পরিবেশে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি মানুষের শরীরেও প্রবেশ করেছে এবং আমাদের স্বাস্থ্যকে নীরবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

৪.টেকসই উন্নয়নের জন্য হুমকি:
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (SDGs) অর্জনের পথে প্লাস্টিক দূষণ একটি বড় বাধা। বিশেষ করে, পরিবেশ সুরক্ষা, নিরাপদ পানি, সুস্বাস্থ্য, জলজ ও স্থলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা—এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

৫.জীববৈচিত্র্য বাস্তুতন্ত্রের উপর হুমকি:
প্লাস্টিক কেবল জলজ প্রাণীকেই নয়, স্থলচর পশুপাখিকেও প্রভাবিত করে। অনেক সময় পাখি বা অন্যান্য প্রাণী খাবার ভেবে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে এবং শারীরিক জটিলতার কারণে মারা যায়। এইভাবে একটি প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র ও বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়।

৬.মানব স্বাস্থ্য অর্থনীতির ক্ষতি:
প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য যেমন ঝুঁকিতে, তেমনি কৃষি, মৎস্য এবং পর্যটন শিল্পও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে ভেসে আসা প্লাস্টিক বর্জ্য এসব এলাকার সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়।

বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ, দ্রুত নগরায়নশীল দেশে প্লাস্টিক দূষণ দিন দিন এক মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার একটি বড় অংশ প্লাস্টিকের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও অন্যান্য শহরে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। এর ফলে শহর ও গ্রামীণ উভয় এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য জমে পরিবেশে তীব্র দূষণ সৃষ্টি করছে।

প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার (যেমন- বিশ্বব্যাংক, UNDP) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে প্রায় লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে প্রায় লাখ টন শুধু ঢাকাতেই ব্যবহৃত হয়। ঢাকায় একজন মানুষ বছরে গড়ে ২৪-২৫ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করেন, যেখানে ২০০৫ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ কেজি। অর্থাৎ, মাত্র এক যুগের ব্যবধানে এর ব্যবহার ৮ গুণেরও বেশি বেড়েছে।

ব্যবহারের পর নিষ্পত্তির অবস্থা

বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। বর্তমানে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাত্র ৩৬% পুনর্ব্যবহার করা হয়, বাকি ৬৪% প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে রাস্তায়, নালায়, খালে, জলাশয়ে পড়ে থাকে। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রায়শই প্লাস্টিকের কারণে বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং নগরজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

এছাড়াও, নদ-নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় এই বর্জ্য জমে মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ব্যাপক হারে প্লাস্টিক বর্জ্য দেখা যায়। নদী থেকে সংগ্রহ করা মাছের পেটেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতির ওপর প্রভাব

প্লাস্টিক পোড়ানো হয় অনেক এলাকায়, বিশেষ করে আবর্জনার স্তূপে আগুন লাগালে তা পরিবেশে বিষাক্ত গ্যাস (যেমন ডাইঅক্সিন ও ফিউরান) নির্গত করে, যা ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সার ও শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে। এছাড়া জমে থাকা প্লাস্টিক নালায় পানির প্রবাহ বন্ধ করে, যার ফলে মশার বিস্তার ঘটে এবং ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়ায়।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই দূষণের প্রভাব ব্যাপক। জলাবদ্ধতা ও নিকাশী সমস্যার কারণে নগরবাসীকে কাজের সময় নষ্ট করতে হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটে এবং স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়।

পরিবেশবাদী উদ্যোগ জনসচেতনতামূলক কাজ

বাংলাদেশে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিক উদ্যোগের মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈরি করছে এবং কিছু স্কুলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতা গড়ে তোলা হচ্ছে। তবে এই উদ্যোগগুলো এখনো সীমিত এবং বৃহৎ পরিসরে কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনার জন্য সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ, কঠোর আইন প্রয়োগ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।

প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ

বর্তমান বিশ্বে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ এক গুরুতর পরিবেশগত সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই দূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করা যায়, যার মধ্যে প্রধান তিনটি হলো:

১. সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার

২. পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিংয়ের অভাব এবং

৩. সামাজিক সচেতনতার অভাব

এই কারণগুলো একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এবং সম্মিলিতভাবে তারা এই দূষণ সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

. সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বা সিঙ্গেল ইউজ করা প্লাস্টিক হলো সেইসব পণ্য যা মাত্র একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয় যেমন- প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, স্ট্র, কফি কাপের ঢাকনা, চামচ, প্লেট, মোড়কজাত সামগ্রী ইত্যাদি। বাংলাদেশে এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে এসব পণ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। কারণ সেগুলো সহজলভ্য, সস্তা এবং ব্যবহার-পরবর্তী নিষ্পত্তির বিষয়ে ভাবার প্রয়োজন পড়ে না।

এই প্লাস্টিকগুলো ব্যবহারের পর প্রায়শই খোলা পরিবেশে, ড্রেনে, নদীতে কিংবা মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। ফলে তা সহজে পচে না, শত শত বছর ধরে থেকে যায় এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। প্লাস্টিকের ব্যাগ ও মোড়ক বৃষ্টির পানি আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে; আবার নদী বা সমুদ্রে গেলে তা সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু ঘটায়।

. পুনর্ব্যবহার রিসাইক্লিংয়ের অভাব

বাংলাদেশসহ অনেক দেশে প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো উন্নত নয়। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার বা রিসাইক্লিং-এর জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি অভাব রয়েছে। ফলে ব্যবহার শেষে অধিকাংশ প্লাস্টিকের বর্জ্য ডাস্টবিন, ড্রেন, খাল, নদী কিংবা খোলা জমিতে ফেলে দেওয়া হয়।

অনেক সময় দেখা যায়, শহরের আবর্জনার স্তূপ থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে ছোট কিছু প্রতিষ্ঠান বা বর্জ্য শ্রমিক তা পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক হিসেবে বিক্রি করার চেষ্টা করে। কিন্তু এটি মোট ব্যবহারকৃত প্লাস্টিকের তুলনায় খুবই কম। আবার অনেক সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক এমনভাবে তৈরি যে সেগুলো রিসাইক্লিং উপযোগী নয়।

পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিং-এর অভাবে প্লাস্টিক কেবল জমতেই থাকে এবং জমে জমে তা এক সময় গ্যাস নির্গমন করে বা পোড়ানোর মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন করে, যা মানবস্বাস্থ্য ও প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

. সামাজিক সচেতনতার অভাব

প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমাজে এখনো অনেকেই প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবগত নয় কিংবা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে না। অনেকেই মনে করে, প্লাস্টিক ফেলে দিলেই সেটা সমস্যা শেষ – কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, এই যেখানে সেখানে ফেলা প্লাস্টিকই পরিবেশে বছরের পর বছর থেকে যায়।

প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার, বারবার ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার, কিংবা রিসাইকেলযোগ্য পণ্য বেছে নেওয়া—এইসব অভ্যাস এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ বা গণমাধ্যমেও এর যথাযথ প্রচার দেখা যায় না। প্রশাসনিক দিক থেকেও জনসচেতনতা তৈরির জন্য নিরবিচারে কোনো দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম দেখা যায় না।

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব

প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। এটি কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য নয়, বরং মানব স্বাস্থ্য, কৃষি এবং সামুদ্রিক

সম্পদের উপরও দীর্ঘমেয়াদী ও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের অপরিকল্পিত ব্যবহার ও নিষ্পত্তির অভাবে এই সমস্যা দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে। নিচে এর প্রধান চারটি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো:

. পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব

প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে থেকে যায় শত শত বছর। যখন এই প্লাস্টিক আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে পড়ে থাকে, তা সূর্যের আলো ও বৃষ্টির সংস্পর্শে ক্ষয় হয়ে একসময় মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপ নেয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক জলজ প্রাণী, পাখি ও স্থলচর প্রাণীদের দেহে প্রবেশ করে এবং তাদের জন্য মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে।

বিশেষ করে সমুদ্র ও নদীতে ফেলা প্লাস্টিক সামুদ্রিক জীব, যেমন- মাছ, কচ্ছপ, ডলফিন ইত্যাদির দেহে জড়িয়ে যায় বা তারা তা খাবার মনে করে গিলে ফেলে, যার ফলে শ্বাসরোধ, অন্ত্রের রোধ, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এছাড়াও স্থলচর প্রাণী যেমন গরু, ছাগল ইত্যাদিকেও রাস্তার পাশের পলিথিন খেতে দেখা যায়, যা তাদের পরিপাকতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি করে।

. মানব স্বাস্থ্যের ঝুঁকি

প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যেও নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক পোড়ালে যে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস নির্গত হয় যেমন- ডাইঅক্সিন, ফিউরান এবং পলিক্লোরিনেটেড বিসফেনল – তা বাতাসে মিশে ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রোগ এবং হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে।

এছাড়াও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা পানির মাধ্যমে, এমনকি লবণ, চাল ও সবজির মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছি, যা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের কিডনি, যকৃত এবং রক্তে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিষাক্ত পদার্থ আরও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলক দুর্বল। ফলে প্লাস্টিক দূষণ এখন শুধু পরিবেশগত নয়, একটি জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

. নদী সমুদ্র দূষণ

বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে নদী ও সমুদ্র দূষণ একটি বড় উদ্বেগের কারণ। শহরের ডাস্টবিন বা ড্রেন থেকে যেসব প্লাস্টিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ে, তা পানির স্বচ্ছতা কমিয়ে ফেলে এবং পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করে। এর ফলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে নিয়মিতভাবে হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে। এই বর্জ্য পানির প্রবাহ ব্যাহত করে, নাব্যতা কমায় এবং সামুদ্রিক খাদ্যচক্রে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়।

প্লাস্টিকের মাধ্যমে সামুদ্রিক পরিবেশে প্লাস্টিক আইল্যান্ড তৈরির ঘটনাও ঘটছে, যেখানে বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিক জমে গিয়ে একটি ভাসমান আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

. মাটির উর্বরতা হ্রাস

প্লাস্টিক দূষণ শুধু পানি বা বাতাসে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের মাটির উর্বরতাও কমিয়ে দেয়। জমিতে ফেলা প্লাস্টিক জমির ভেতর পানি ও বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত করে এবং মাটির স্বাভাবিক জৈব উপাদান গঠনে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলস্বরূপ, উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং দীর্ঘমেয়াদে জমির উর্বরতার কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়।

বিশেষ করে আমাদের চাষাবাদের জমিতে যদি পলিথিন বা প্লাস্টিক মোড়ক পড়ে থাকে, তাহলে তা চাষাবাদের গুণগত মান ও ফসলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। আবার গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে প্লাস্টিক মিশে গেলে তা সার তৈরির উপযোগী থাকে না, ফলে জৈব সার উৎপাদনেও সমস্যা দেখা দেয়।

প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধের অন্যতম উপায়

প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ কোনো একক প্রচেষ্টার ফল নয়; এটি একটি সমন্বিত উদ্যোগ, যার মধ্যে ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র সকলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে এই দূষণ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, তবে কিছু কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট অনেকাংশে প্রশমিত করা সম্ভব। নিচে প্রতিরোধমূলক কিছু কার্যকর পন্থা বিশদভাবে তুলে ধরা হলো:

. একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো

সিঙ্গেল ইউজ বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক হলো পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। তাই এই ধরণের প্লাস্টিক যেমন- পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক বোতল, প্লেট, চামচ, স্ট্র ইত্যাদির ব্যবহার যতটা সম্ভব সীমিত করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাপড়ের ব্যাগ, কাঁচের বোতল বা ধাতব পাত্র ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

সরকারি পর্যায়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে যেমন পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি ও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিকল্প উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে।

. পুনর্ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি

প্লাস্টিকের বদলে জুট, কাপড়, বাঁশ, কাচ স্টেইনলেস স্টিল-এর মতো টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপাদানের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে যেমন- বাজার করতে গেলে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার, খাবার পরিবেশনে মাটির বা কাচের পাত্র ব্যবহার এবং বারবার ব্যবহারের উপযোগী বোতল বা কনটেইনার বহনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

এছাড়াও সরকার ও উদ্যোক্তাদের দরকার পরিবেশবান্ধব পণ্যের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারকে ভর্তুকি বা কর ছাড়ের মাধ্যমে উৎসাহিত করা, যাতে সাধারণ মানুষ সহজে সেগুলো গ্রহণ করতে পারে।

. প্লাস্টিক বর্জ্যকে জৈব অজৈব বর্জ্য থেকে আলাদা করে ফেলা

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো বর্জ্য শ্রেণিবিন্যাস বা বর্জ্য আলাদা করা। যদি প্লাস্টিক বর্জ্যকে জৈব ও অন্যান্য বর্জ্য থেকে আলাদা করে ফেলা যায়, তবে তা সহজে রিসাইক্লিংয়ের জন্য পাঠানো যায় এবং অন্যান্য বর্জ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে না। এই অভ্যাসটি গৃহস্থালি পর্যায় থেকে শুরু করে অফিস, হোটেল, বাজার এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সকল জায়গায় বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আলাদা ডাস্টবিন ব্যবহারের মাধ্যমে শুরু করা যেতে পারে এবং স্থানীয় সরকারগুলোর উচিত আলাদা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা চালু করা।

. পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলোর প্রচার

পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রচারের জন্য শুধু বিজ্ঞাপন নয়, বাস্তবিক উদাহরণ ও অনুকরণীয় উদ্যোগের প্রয়োজন। সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার এবং স্থানীয় উদ্ভাবনগুলোর প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

বাজারে বর্তমানে অনেক বিকল্প পণ্য রয়েছে যেমন- জুট ব্যাগ, কর্ণ স্টার্চ-ভিত্তিক মোড়ক, মাটির কাপ, কাগজের স্ট্র ইত্যাদি – এসব পণ্যের সহজলভ্যতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে মানুষকে জানানো এবং উৎসাহিত করাও জরুরি।

. স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচিতে প্লাস্টিক দূষণ অন্তর্ভুক্ত করা

দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য শিক্ষাকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যদি পরিবেশ সচেতনতা ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা যায়, তবে তারা ভবিষ্যতে একটি দায়িত্বশীল প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠবে।

এ জন্য স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর দিক এবং প্রতিরোধের উপায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাছাড়া পরিবেশ-সচেতনতা বিষয়ক সহপাঠ কার্যক্রম, আলোচনা সভা, প্রতিযোগিতা ও বাস্তবভিত্তিক প্রকল্প শিক্ষার্থীদের মধ্যে কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে।

 

সামাজিক সচেতনতা উদ্যোগ

প্লাস্টিক দূষণের বিস্তার রোধে সামাজিক সচেতনতা ও জনসচেতন উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর একটি দিক। আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তিগত সমাধান বা সরকারিভাবে নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি জনমানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ছাড়া এই সংকট দূর করা সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে সচেতন ও দায়িত্ববান নাগরিকগণই পারে এই দূষণ প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিতে। নিচে দুটি মূল দিক বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা হলো:

. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন কর্মসূচি

জনসাধারণের মধ্যে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব, বিকল্প পণ্যের ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি। এই ধরনের ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জনগনকে দেখাতে হবে, প্লাস্টিক কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবন, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলছে।

বিভিন্ন ধরণের কার্যকর কর্মসূচি হতে পারে:

  • স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ
  • সামাজিক সংগঠন, এনজিও ও পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে র‍্যালি, পোস্টার প্রদর্শনী ও পথনাটক
  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও, গ্রাফিক্স ও তথ্যচিত্র প্রচার
  • স্থানীয় বাজার, সুপারশপ ও হোটেলে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ
  • প্লাস্টিক মুক্ত এলাকা ঘোষণা ও বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় জনগণের অংশগ্রহণ

এই ক্যাম্পেইনগুলো বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও শহরাঞ্চলের ভোক্তাদের মধ্যে দ্রুত প্রভাব ফেলে, ফলে তারা নিজেদের ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ হয়। সামগ্রিকভাবে সচেতনতা তৈরি হলে ব্যক্তিগত ব্যবহার থেকে শুরু করে সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক আচরণেও পরিবর্তন আসবে।

. পরিবেশ সংরক্ষণে নাগরিকদের ভূমিকা

যে কোনো পরিবেশগত সংকট নিরসনে নাগরিকদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক নাগরিক যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করে, তবে তা মিলিতভাবে বৃহৎ প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন:

  • প্রতিদিনের বাজারে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার
  • বাসা থেকে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য আলাদা করে ফেলা
  • নিজের পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতন করা
  • উৎসব বা সামাজিক অনুষ্ঠানে ডিসপোজেবল প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার
  • অনলাইন বা সরাসরি প্লাস্টিক দূষণবিরোধী পিটিশনে স্বাক্ষর করে বা তহবিলে অংশগ্রহণ করে সক্রিয় সহায়তা প্রদান

নাগরিকরা যদি নিজেরা সচেতন হন এবং অপরকে সচেতন করেন, তবে প্লাস্টিক ব্যবহারে সামাজিক চাপ তৈরি হয় – যা বহু ক্ষেত্রে আইন ও প্রশাসনের চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে। এছাড়া নাগরিকদের উচিত পরিবেশ সংরক্ষণে দায়িত্বশীল প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন, আন্দোলন বা ফোরামের সাথে যুক্ত হওয়া, যাতে বড় পরিসরে তারা নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারা যায়।

পরিশেষ

প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার সমাধানে শুধুমাত্র একক কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা দাবি করে; যেখানে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সরকারী স্তরে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে এই দূষণ রোধ করা সম্ভব।

প্লাস্টিক দূষণ যেহেতু একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা, সেকারণে এর সমাধান ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে। এটি এমন একটি সংকট, যা সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে মানবজাতি এবং পৃথিবী দু’টি খুবই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। একমাত্র প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা, সমাজের উদ্যোগ এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ একত্রিত হলেই এই দূষণের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সংগ্রাম সম্ভব। আমাদের পরিবেশ রক্ষা এবং পৃথিবীকে সবুজ সুন্দর রাখতে এই সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব।

 

Leave A Comment

Your Comment
All comments are held for moderation.